Sunday, March 7, 2021

গুয়ামৌরী

 ঘড়িঘরের দিক থেকে ভেসে আসা বসন্তের ছোবল মারা হাওয়া বুকের মধ্যে নিকষ কালো গর্ত করে দিয়ে ডাঙ্গার উলটোদিকে পালে ধাক্কা মারতেই তাড়াহুড়ো করে পাল নামানোর তোরজোর শুরু হল। 

বসন্তকালের হাওয়ার মধ্যে কিছু একটা কালো ভেল্কি আছে - মন বড়ো হুহু করে ওঠে। 

দুরে ঢিপি ঢিপি কালো অন্ধকার মাখা নিস্তব্ব্ধ জঙ্গল, নৌকায় কোনরকম সুর-তালের সঙ্গত ছাড়াই উচ্ছ্বসিত নাচের পদধ্বনি, নিঃশ্বাসের হুশহাশ,  আনন্দ-মাখা অর্ধচ্চারিত শব্দ।


রোশন মিঞ্জ-কে এক-পেগ কড়া করে বানানো ওল্ডমঙ্ক হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম 'তোমাদের গ্রামে সব্বাই নাচতে পারে? মানে কোনও নির্দিষ্ট ঘরানার নাচ?' 

প্রবল বৃষ্টিতে আমার ঘরের বারান্দায় আটকে পরা জনৈক সুইগি-ডেলিভারিম্যান সপাটে উত্তর দিলো, 

'না স্যার, আমাদের কি আর অত লেখাপড়া, মাষ্টারমশাই ওসব আছে? যা মন চায়, তাই নাচি। সাপের লড়া দেখে নাচ পায়, কিম্বা এইরকম বৃষ্টিতে নদীর পাড় ভেঙ্গে পরছে সেই দেখে নাচ পায়। একবার তো পাথরপাড়া ছাড়িয়ে আমার মামার গ্রামে তিনি এলেন...'

'তিনি মানে?'

'বাগ গো স্যার।'

'বাঘ?!' 

'হ্যাঁ গো। সেই বাগ দেখে আমার ঠাকুমা এমন নাচলো বাগও পালিয়ে গেলেন। তারপর খুব ঘটা করে পুজো হল।'


প্রবল বৃষ্টিতে দিকনির্ধারণ করা সমুদ্রের দেবতারও অসাধ্য। মেঘ আর তাঁর বৈরিতার জন্যেইতো এত বৃষ্টি। নৌকার ক্যাপ্টেন, ছিটকে আসা কাদা মুছে তিনি বললেন জঙ্গলের বাইরেই তাঁবু লাগাতে। ইলশেগুঁড়িতে আগুন জালানো বড়ো দায়।

দক্ষিণ-পূর্বের হিন্দু-রাজা তাদের তাড়িয়েছে রাজধানী থেকে। সদ্য পবিত্র রাজধানী বানিয়েছেন রাজা জঙ্গল কেটে, বাঘ তাড়িয়ে। তিনি, তাঁর পূর্বপুরুষ দের মতই বিরাট মন্দির নির্মাণে নিয়োজিত হয়েছেন যা পরবর্তীকালে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ফরাসী কোলোনাইজারদের কাছে আঙ্করভাট হয়ে থেকে যাবে। নৌ-সফরকারীদের বাং-মাছের মত শরীর, কালো আবলুশ-কাঠের মত রঙ, অজানা ভাষা আর প্রকৃতির সাথে একাত্য হওয়ার অপার্থিব ক্ষমতা তাঁর সনাতন হিন্দু ধর্মের আচার-অনুচার, শত্রুমিত্রের সংজ্ঞায় আসছিল না। যখন লড়াই হয় আমাদের নজরের বাইরে তখন দেবতারাও বুঝতে পারেন না কোন পক্ষে থাকা উচিত। তাই হয়ত সুন্দরবনের বসতি গড়ার দিনে নৌ-সফরকারীদের দেশ ছেড়ে আসার অসহনীয় দুঃখ এবং রাগ দিয়েও বাঘ-কুমিরের হাত থেকে চিরকালের জন্যে রক্ষা করলেন। বা হয়ত এই মানুষগুলো নিজের সুরক্ষা আর দিনযাপনের জন্যে প্রকৃতির সাথে হাজার হাজার বছর ধরে মানিয়ে নিয়ে, নিজের ওজরমত তাকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারত। কারণ জঙ্গল তো তাঁদের নিজেদের-ই। তারাও জঙ্গলের-ই। কাদাখোঁচা কিম্বা মিষ্টি জলের কুমির আর তাদের কোন তফাত নেই। মেটে ইঁদুর সুনামি, ভূমিকম্পের গন্ধ পায়, তারাও পায়। সভ্যতা শুধু কর্ম-সংস্থান করেনি তাদের মহাজনের খেতে। তারা গন্ধ শুঁকে মিথ্যেবাদীও চিনে নেয় এখন।  

পরের কয়েকদিন ধরে ওরা বসতি বানালো সুন্দরবনে। দুর দিয়ে বাদাবনের দিকে মেছোনৌকা যেত, তারা জলের দরে চিংড়ি-কাঁকড়া বেচে আসত। যে চিতি-কাঁকড়ারা গহন বর্ষার দিনে ডিম পারতে আসত বালির খাঁজে তাঁদের কানে কানে ফিসফিস করে দু-কান কথা বলত এরা। জালবন্দী কাঁকড়াগুলি নিস্তব্ধ হয়ে দেখত কোটি কোটি চারা সার বেঁধে কাদার উপর দিয়ে নোনাজলে ভেসে যাচ্ছে নতুন জীবনচক্রের উদ্দেশ্যে। জোছনা কুড়ে খাচ্ছে বালির উপর পদচিহ্ন। পরের বর্ষায় তারা আবার ফিরে আসবে।

আর ছিল গুয়ামৌরী।

তাদের গ্রামে এই গুয়ামৌরী আগে হতোনা। সমদ্রের দেবতা নাকি তাঁর স্ত্রীর শরীরের মেছোগন্ধ সহ্য করতে পারতেন না। তিনি সর্বদাই বিমর্ষ, তাই এই অঞ্চলের উপকূল ঘিরে রইত ঘন মেঘের আড়ালে। প্রতিদিন সূর্য ডোবার আগে অঝরে বৃষ্টি হত। 

তখন জঙ্গলের দেবী তাঁকে এই গুয়ামৌরী এনে দেন, তাঁদের প্রাসাদের বেডরুমে ঘিয়ের সাথে জালানোর জন্যে। অন্তর্বাসে রাখার জন্য। 

পরে এই গুয়া মৌরীর আশ্চর্য গন্ধের কথা জানাজানি হওয়ায় দেবতার পৃষ্ঠপোষকেরা টা ব্যাবহারের সুযোগ পায়। তখন রাজপ্রাসাদের এক বাবুর্চি খানিকটা গুয়া মৌরী চুরি করে রাখে যাতে পরে স্মাগল করতে পারে। ঘটনাচক্রে একদিন মাতাল অবস্থায় রান্না করতে করতে ভুলবশত খানিকটা গুয়া মৌরী মাংসের সুরুয়ার মধ্যে পড়ে যায়। 

অজানা মিষ্টি গন্ধে ছোটবেলার স্মৃতি মনে পরে বাবুর্চির। হঠাৎ শীতের কুয়াশা নেমে আসে, তার মাঝে ভোরের সূর্য ওঠার নরম ওম চারদিকে ছড়িয়ে পরে। সারা রাত ধরে ফসল কাটার ক্লান্তির সাথে গরম গরম খাবার আর বিশ্রামের কথা মনে পরল। ম ম করছে তখন সদ্য কাটা ধান আর মাংসের সুরুয়ার গন্ধ। উঠানের কোনায় গুড় জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। চালের রুটি বানানো হচ্ছে। সদ্য কাটা মাছের টুকরো লাফাচ্ছে কুয়োর ধারে। ভীষণ আরামে ঘুম এসে গ্যাল তার।   

গুয়া মৌরী খাবারে দেওয়ার রেওয়াজ তখন থেকেই। 


রাজার তদবিরে উত্তর-পূর্বের আগ্নেয়গিরির দিকের জঙ্গলে অভিযান করা হল। প্রাণ গ্যাল কতো লোকের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুঁজে আনা হল গুয়ামৌরীর চারা। প্রচণ্ড গোপনীয়তার সাথে চাষ করা হল সেই চারা। শীতের শুরুতে ফসলের বন্যা হয়ে গেল। সমুদ্রের ওপারের বেদুইনরা বহর নিয়ে এলো, সোনা-মাণিক্য দিয়ে কিনে নিয়ে গেল গুয়ামৌরী। 

সেই দেবতাদের দুর্লভ গুয়ামৌরী তারা নৌকা করে এনেছিল তাদের নতুন বাসস্থানে। 


নতুন মাটি-জলে গুয়ামৌরীর আচার আচরণ গেল বদলে। 

লোকে বলল, গুয়ামৌরী বিষ! এর স্বাদে-গন্ধে মানুষ পাগল হয়ে যায়।  

   

গুয়া মৌরীর প্রভাবে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ল নাচের রোগ।

ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-ঝি দরজা খুলে রাস্তায় নেমে পরল নাচতে নাচতে। 

বসন্তের আলোয় হিজাব ছিঁড়ে দলে দলে মেয়েরা নাচতে নাচতে ঢুকে পরল পুকুরপাড়ের মসজিদে। 

যাদের মন্দিরে ঢোকা মানা তাদের নাচের চোটে কেঁপে উঠল দালানকোঠা, নাটমন্দির। 

জমিদারের কোতোয়ালি জমে উঠল গরীব অপরাধীদের নাচে। 

জঙ্গল নেচে উঠল কাঠুরিয়া, মৌলীদের সাথে।

লাটসাহেবের কর্মচারীদের বাংলো ভয়ে কেঁপে উঠল নেটিভের আনহোলি নাচে।

নীল আর পোস্তর খেত নেচে উঠল। 

বন্দর নেচে উঠল।

রোদ্দুর নেচে উঠল, রাতের ঝিঁঝিঁর ডাকও নেচে উঠল। 

যতক্ষণ ক্লান্তি নেই ততক্ষণ নাচ। 


সুইগি-ডেলিভারিম্যানের বক্তব্য অনুযায়ী গুয়ামৌরী থেকে ছড়িয়ে পরা নাচের মহামারীর কারণে সরকারের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের যথেষ্ট অসুবিধা হয়, তাই পুলিস-প্যারামিলিটারি পাঠিয়ে সমস্ত গুয়ামৌরীর ফসল জ্বালিয়ে উজাড় করে দেওয়া হলো। কিন্তু নাচের রোগ এখন কিছু লোকের সারেনি। বরং বংশপরম্পরায় রোগ বয়ে এসেছে তারা।

যখন তখন মাথাচারা দিয়ে ওঠে। 


Saturday, August 1, 2020

আলমারি

নানারকমের অবাস্তব কথা বাড়িয়ে অস্বস্তিতে ফেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।
বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে রোগ ঢুকে পরল বলে, আমার কাজ জানানো। জানাচ্ছি।
গতকাল জানলাম, মিয়েপোয়া মানে ছাঁচিপেঁয়াজ, সেলারি, গাজর দিয়ে বানানো ফরাসি ফ্লেভার-বেস। তার আগের দিন জানলাম কালো মহাকাশের পরদার আড়ালে চোদ্দ বিলিয়ান বছর আগেকার বিগ-ব্যাঙ্গের মাইক্রো-ওয়েভ রেডিয়েশান গিজগিজ করছে, খালি চোখে দেখা যায় না। আমরা নাকি নিজেদের কনশাসনেসের অতিগোলকের মধ্যে আবদ্ধ, প্রতিটা কন্সেন্ট্রিক গোলক এক-একটি সময়সীমা। 

আজ দুইদিন হল কাজের মাসি আসা শুরু করেছে। অফার করেছিলাম আমার বাড়িতেই এই দুর্দিনে থেকে যেতে, কিন্তু বর ইনফিডেলিটির সন্দেহে পেটাবে বলে সে থাকেনি। পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে যাওয়া শ্রেয় মনে করেছে। 

চোখে জল এসে গেছিল ওর হাতে বানানো হাঁসের ডিমের ঝাল, মুড়ি দিয়ে খেয়ে। দেশ বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। 


এই অব্দি পড়েছিলাম টেক্সটটা, মাকে জিজ্ঞেস করলে বলত, কদিনই-বা বাঁচব, অনেক পুরনো বন্ধু। স্ত্রী-বিয়োগের পর এত বছর একা আছে, আমাদের বয়েসে এত কিছু তো ছিলনা, তাই বেসিক যোগাযোগই মানুষকে জীবনবিমুখ হতে দেয়না। আমি মনে মনে এই দুই ষাটোর্ধের প্লেটোনিক আড্ডাকে এখন সমর্থন করি। কারণ বিবাহ এক অত্যন্ত প্রব্লেমাটিক ইন্সটিটিউশান এবং এই কনট্যেক্সটে মা এবং বাবার সোশাল-কন্সট্রাক্ট একেবারেই আলাদা। অবশ্য এইসব সেইসময়কার কথা যখন মা বাবা দুজনেই কথা বলতে পারতেন। 


বছরের মাঝমাঝি থেকেই শীতের সেকেন্ড-ওয়েভের ভয়ে অবস্থাপন্নরা শহর ছেড়ে গ্রামে জমি-বাড়ি কেনা শুরু করে। সেই অজুহাতে গ্রাম-কে-গ্রাম শ্মশান হয়ে যেত, বেশিরভাগই হোম-আইসিইউ নেওয়ার মত অবস্থাপন্ন ছিলনা। বেঁচে ছিল চামার-কৈবর্তরা, অপরিসীম রোগের প্রকোপ সত্ত্বেও। হাজার হাজার বছরের জুতো-লাথি-অসম্মান, খালি পেট, রোগব্যাধি, দারিদ্র শরীরের কোশেকোশে সারভাইভালের অ্যালগরিদম তৈরি করে গ্যাছে। বাড়ির পেছনেই অকল্পনীয় দারিদ্রের মধ্যে চামারবস্তি ছিল। ওরা কেটেকুটে শুয়োরের গলা-কাঁধের মাংস আর এন্ট্রেলস দিয়ে যেত। মা সুন্দর করে মৌরীগুঁড়ো, কালোরসুন আর ঝাল মরিচ দিয়ে সসেজ বানিয়ে রোদে দিতেন। নুনের গদি ছিল দুরের জঙ্গলে। কেউ যেতনা সেখানে। গ্যাল বছরের কলেরার রোগীদের ড্রপিংস এখন নাকি সেখানের জল মাটিতে। যারা সেখানে ঘোরাফেরা করে তাঁরা নাকি সবাই মানুষ না। কেউ না কেউ তাঁদের মধ্যে ফিরে আসে গ্রামে পথ দেখাবার অজুহাতে। তারপর সেই গ্রাম আর গ্রাম থাকে না। কালো মেঘের মত রোগ পিছু নেয়। তাই তারা, নুনের মাইনাররা, তিন হপ্তার জন্যে জঙ্গল যায়, যতখানি পারে সংগ্রহ করে পশ্চিমপারের পীরবাবার আশ্রমে আরও দুহপ্তার কোয়ারেন্টাইনের জন্যে আসে, ওরা বলে পীরবাবা শ্মশানের ছাই আর জার্মানি থেকে আনা অ্যান্টিভাইরাল মেশান গুঁড়ো খাইয়ে কাবার দিকে মুখ করে এক প্রচণ্ড হুঙ্কার দেন।
মাদারচোদ আল্লা তোর মাকে চুদি এদের সবাইকে না সারালে। ইসলামের শুরু মা চুদে, শেষ মা চুদে। হিঁদুর শুরু মা চুদে, শেষ মা চুদে। গরিবের বাঁচার প্রোটকল ছিল টাকা। 


আমাদের ঘরে এক প্রকাণ্ড ঠাকুরদালান ছিল। কোন পড়ন্ত জমিদারের বাইজির বাড়ি ছিল এটা। অবস্থা ঠিক করতে, বাবা আগে গিয়ে বসবাস করা শুরু করেন। আমি যাই বাবার সাথে। বাবা সকাল হতে কম্পিউটার নিয়ে কাজে বসতেন, বেলা বাড়লে আমাকে সাথে নিয়ে মিস্ত্রীদের তদারকিতে যেতেন। মিস্ত্রীরা আমাকে খেলার জন্যে গোসাপের চামড়ার একটা ডুবকি দিয়েছিল, বাজাতে পারতাম না, কিন্তু সারাক্ষণ বাজাতাম। বাবা বলতেন আমি ঘরে ঢোকার আগে ডুবকির চাপকারি ঘরে শোনা যাবে। সন্ধ্যে হলে বাবা পাতা গলাতেন আর মদ খেতেন। তখন সেই বাড়ির রিয়েলিটি বদলে যেত। তাণ্ডব করতেন সারা বাড়ি জুড়ে, অসংলগ্ন কথা একো করত প্রতিটা দেওয়ালে। সবকটা  ঘর যদিও খোলা ছিলনা। কাবার দিকের ঘরটায় খোলার আমাদের চারজনের পরিবারের দরকার ছিলনা, সবাই বারণ করেছিল। কিন্তু বাবা একদিন সন্ধেবেলা অমানুষিক শক্তিতে লাথি মেরে দরজা ভাঙ্গেন। ঘরে আর কিছু নেই, দেওয়ালের পিঠে এক দৈত্যাকার আবলুশ-মেহগনি মেশানো গথিক আলমারি। চাবি নেই, হাঁহাঁ করা খালি অন্তঃস্থল। বাবা বললেন এই ধরনের কারপেন্ট্রি দেশ থেকে অবলুপ্ত হয়েছে একশো বছর হল। আয়না প্যারিসের থেকে আনা স্ফটিকের মত। 

পরদিন ঘুম থেকে উঠে বাবা কে দেখলাম আলমারির সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে আছেন। মুখে অপরিসীম শান্তির হাসি। আমি আমার জীবদ্দশায় এই শান্তি কোনদিন দেখিনি। অবাক হয়ে সামনে যেতে বুঝলাম তিনি অত্যন্ত নেশাগ্রস্থ, বাকশক্তি ঠিকঠাক নেই। নানারকমের শব্দ করছেন, মানে ব্যাতিত শব্দ। অতি কষ্টে বুঝলাম তিনি বলছেন মা ফোন করেছিল, আমি যেন কথা বলে নি। মাকে কলব্যাক করলাম। তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত ডিটেলড। বাবা নাকি তাঁদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের নানারকমের ভুল স্বীকার করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন। মা খুবই চিন্তিত বাবা নেশার মাত্রা বাড়িয়েছেন কিনা। আমি অসময় ফোন রেখে দিলাম। 


দুপুরে খাওয়ার সময় দেখলাম বাবা সম্পূর্ণ রূপে কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন। যাই বলা হোক না কেন তিনি অঙ্গভঙ্গি করে উত্তর দিচ্ছেন, এবং তাই নিয়ে তাঁর কোন অভিযোগ নেই। 

সেই রাতে মিস্ত্রীদের সরদার এসে বললেন বাবাকে বাঁচাতে হলে আলমারির ঘরে না যেতে দিতে। 


মা তাড়াহুড়ো করে এলেন বাবার খেয়াল নিতে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আসেপাশের ডাক্তার ডাকলেন। কোন রোগের ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। বাবা দুপুরে হাঁসার মাংস দিয়ে গুছিয়ে ভাত খেলেন। সন্ধ্যে বেলা নেশা না করে গিরিজা দেবীর গান চালালেন। যতোবার মার দিকে চাইলেন, প্রেমিকের মত করে চাইলেন। আমি রাতে মামারবাড়ি  খেলতে গেলাম, রাতে লুচি, বেগুণ ভাজা, নলেন গুড়  খেয়ে ওখানেই ঘুমালাম। 


পরদিন সকালে এসে দেখলাম মার একইরকম ভাবে কথা হারিয়েছে। ভিতরে ঢুকে দেখলাম মা বাবা হাত ধরাধরি করে আলমারির ঘরে মাটিতে বসে আছে। একে অপরের চোখ মোছাচ্ছে। যেন আলমারির ভেতর থেকে অপার্থিব কোন শক্তি এসে বাবা-মায়ের থুতু দিয়ে জোড়া সংসারের কঠিন সমস্যাগুলো নিমেষেই সমাধান করছে, বদলে কথা বলার ক্ষমতা অপহরণ করে। 


এরপর বহুবছর বাবা-মার কেউ কথা বলেননি। প্রায় এক দশক। মহামারি নিজের স্বভাবমতো জঙ্গলে ফিরে গেছে। অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে। মৃত্যুহার কমেছে। কিন্তু মা-বাবার সংসার আরও মজবুত হয়েছে। বেসিক মিসোজিনিস্ট অসুবিধে গুলো চলে গ্যাছে, দুজনের মধ্যে অপূর্ব টিমগেম-এর সূচনা হয়েছে যা আমি কোনদিন দেখিনি। মা এখন অসম্ভব অনুগত বাবার, বাবা নেশা এবং নানারকমের নেশা সংক্রান্ত অবিবেচনা ত্যাগ করে মানুষের মত মানুষ হয়েছেন।

  

মহামারির অনেক দিন পর বাড়ি বেচার সূত্রে আমি গ্রামে ফিরি। আলমারি এখন বহাল ঘরের মাঝামাঝি, সূর্যের আলো নিভিয়ে। দরজা খুলে দেখি এক অদ্ভুত মায়া যেন বলছে আমি আলমারির মধ্যে জীবনের নিগূড় সত্য খুঁজে পাব। আমি তদ্দিনে জীবনের নানা অধ্যায় কাটিয়ে ডিরেকশানলেসনেস এক চরম সীমায় প্রতিনিয়ত কাটাই। আলমারির ডালা খুলে ভেতরে ঢুকে বসি। কাঁপা হাতে বন্ধ করি ডালা, ভেতর থেকে। 


নিমেষে আলমারির ছাদ থেকে বৃষ্টির মত মানুষের হাড় পড়তে থাকে। খেয়াল করে দেখি, হাড়গুলি সবই উপরের চোয়াল বা নিচে চোয়ালের, কয়েকটি মাড়ি-দাঁত সুদ্ধু। কয়েকশো মানুষের জীবনের মূলধন হাওয়ায় উড়ে গেছে নিজেদের মধ্যে কথার অভাবে। আজ কোন অজানা শক্তিতে, না বলা কথা, সর্বশক্তিতে, সম্পর্কের ঘুণ পরিষ্কার করার মানসিকতা অপার্থিবভাবে সম্প্রচার করছে। পাঁক পরিষ্কার করার এক আনইন্টারপ্রিটেব্ল মেশিনারি। 


মা-বাবার মৃত্যুর পর আলমারিটাকে বাড়ি নিয়ে আসি। দুঃখের বিষয়, আমার ব্যাক্তিগত সমস্যায় সে কোনদিন কোন সাহায্য করেনি। কয়েকবার তো আমি মনে মনে প্রার্থনাও করেছিলাম যাতে আমার বাকশক্তি চলে যায়।


আজ মনে হয় মানুষ নিজেদের অপারগতাকে বড্ড বেশি করে সুপারন্যাচারাল জিনিশের উপর প্রজেক্ট করে।    


Wednesday, May 6, 2020

অ্যাস্ট্রনমিকাল অডস

হঠাৎ প্রচণ্ড মেঘগর্জনের শব্দ।

রিংপচে  দাঁড়িয়ে আছে ছাগল চড়ানোর রাস্তার শেষ প্রান্তে, এখান থেকে নিজের ঘর পর্যন্ত সারা রাতের হাঁটা পথ। কিন্তু সে কিছুতেই গাঁয়ে ফিরে যাবে না। তার মধ্যে সবাই শয়তানের ছায়া দেখতে পায়। সন্ধ্যের অন্ধকার মেশা ছাই-রঙ্গা বরফের লম্বা ফালি ফালি দাগ জঙ্গলময়। প্রবল তুষারপাতও কয়েকশো ফুটের ক্যানোপি ভেদ করে পুরোপুরি মাটিতে এসে জমা হতে পারেনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রিংপচে, অস্নাত, অভুক্ত, শীতে অসাড়। নীল মন্ত্রযান আঁকা ভারী টিউনিক থেকে শতাব্দী প্রাচীন তন্ত্রসাধনার অপ্রাকৃতিক গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পরছে। আকাশে সিঁদুরে রঙ। বেগুনী আভা।

মেয়েটির প্রথম মনে হল এয়ারক্রাফটের মধ্যে মেঘগর্জনের শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা না। তাহলে কি লাস্ট টার্বুলেন্সের সময় কোথাও স্ট্রাকচারাল ড্যামেজ হয়েছে? ততক্ষণে পাইলটের আশ্বাসবাণী শোনা গ্যাল পিচ-কারেক্টেড স্পিকার থেকে। ডানার নিচে একটা ছোট গর্ত হয়েছে, চিন্তার কিছু নেই, সবাই অক্সিজেন মাস্ক ব্যাবহার করুন। মেয়েটির সীট ডানার সামনেই। টেনিস বলের সাইজের গর্ত তার আশেপাশের স্পেস- টাইম ডিস্টরট করে প্রবল শক্তিতে গিলে খাচ্ছে প্লেনের ভেতরকার রেফ্রিজারেটেড অক্সিজেন, সীটের পিছনে ভয়াবহ টান। জানলার ধারের দক্ষিনী মহিলাটি চিৎকার করে উঠতেই মেয়েটি গলা বাড়িয়ে দেখল বাঁদিকের ডানাটা ডাস্টবিনে মুড়িয়ে ফেলে দেওয়া ঠোঙ্গার মত দেখতে হয়ে গেছে। ছোট গর্ত তখন বল লাইটনিঙ্গের আকার ধারণ করেছে। শক্তি বেড়েছে বহুগুণ। আসন্ন মৃত্যুর মুখে দুশ ছাপ্পান্ন জন যাত্রীর সমবেত কলকাকলি, পাইলটের কথা, অ্যালার্মের শব্দ, মাইকের কানফাটানো ফিডব্যাক, অল্টিটিউড লুজ করার জন্যে কানে অসম্ভব ব্যাথা,   হঠাৎ সবকিছু ছাপিয়ে শোনা গ্যাল গাছবোমা ফাটার মত শব্দ, সীটবেল্ট খুলে ওঠার আগেই অতি অবহেলায় ডানাসহ, প্লেনের বাঁদিকের কিয়দংশ প্লাস্টিকের খেলনার মত টুকরো টুকরো হয়ে হাজার হাজার ফুট উঁচুতে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ল। 

ভারী তাঁবুর নিচে মেকশিফট বিছানায় ঘুমিয়ে ছেলেটি স্বপ্ন দেখছিল ফুটো প্যারাসুট নিয়ে সে অত্যন্ত সাবলীল ভাবে সমুদ্রগর্ভের দিকে ফ্রি-ফল করছে। প্রতি মুহূর্তের বর্ধিত গতিবেগের সাথে কি যেন এক অশালীন সখ্যতা, নিশ্চিত মৃত্যুর সাথেও। যদিও তাকে আজ অব্দি কক্ষনও বন্দুক চালাতে হয়নি। তার অসাধারণ ডকুমেন্টেশান স্কিলের কথা মাথায় রেখে কতৃপক্ষ তাকে রেডার যন্ত্রগুলির কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্সের কাজ দিয়েছে। কাজটির একটা বিশেষ স্ট্যাটিসটিকাল ধরন রয়েছে। যদি রেডার হঠাৎ আইডেন্টিফাই করে শত্রু এয়ারক্রাফটের আনাগোনা এবং সেটি যদি সত্য কিম্বা ফলস-অ্যালার্ম হয় তাহলে সেই পরিসংখ্যান অ্যাক্সেপটেব্ল, কিন্তু যদি সত্যিই অ্যাটাক হয় এবং রেডার যেটি যাচাই না করতে পারে সেটির ফল হয় ভয়াবহ। মৃত্যু ঘনিয়ে আসে, মেরে নিয়ে যায় কাতারে কাতারে। কদিন আগে ছেলেটি লক্ষ্য করেছিল, এক সপ্তাহ ধরে যদি প্রতিদিনের রেডারগুলির ট্রু-পজিটিভ/পসিটিভ আর ফলস-নেগেটিভের/নেগেটিভের অনুপাত নেওয়া যায়, এবং ইন্টারভালে প্লট করা যায়, তাহলে সেটি টেস্টিং এর পাওয়ারের তুলনায় অনেক কন্সিস্টেন্স স্কোর দিতে পারছে। তার এই আপাত আবিষ্কারের কথা কেউ বিশ্বাস করবেনা, এবং সে জানায়ওনি কাউকে। প্রতিদিন পঙ্গপালের ঝাঁকের মত ফাইটার প্লেন আসে, বোমা ফ্যালে নানা প্রান্তে, মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। রোজ মৃত্যুর হিসেব করা হয় শেষ রাতে, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করা হয়। সেই মিটিঙে ছেলেটির রেডার মেশিন যাচাই করার ইম্পেকেব্ল রেকর্ডের রোজ প্রশংসা করা হয়। রোজ শবদেহ বয়ে নিয়ে যেতে হয়, সে ফিরে এসে মন দেয় গ্রাফ পেপারে। রেডারের অ্যাকিউরেসি মাপে আর ভাবে এই দৈত্যাকার অসঙ্গত প্যাটার্নলেস ইউনিভারসে বেঁচে থাকার অ্যাস্ট্রনমিকাল অডসের কথা। তখনই এক প্রচণ্ড শব্দে সে সংজ্ঞা হারায়। 

সব শব্দ থেমে গেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্যে প্লেন থেকে ছিটকে পড়ার পর, শূন্য দিয়ে নক্ষত্রবেগে নিচে পড়ার সময়কার ঊর্ধ্বমুখী শৈত্যপ্রবাহে হুঁশ ফিরল মেয়েটির। চোখদুটো যেন মুখ থেকে ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। সম্বিত ফিরতে মেয়েটি ভাবল, বাঁচার আশা নেই। সীটশুদ্ধ বেল্ট লাগানো অবস্থায় চেয়ারে বসে বসেই সে মাইলখানেক নিচের আণবিক পাহার, জঙ্গল ঘর বাড়ির দিকে ধেয়ে চলেছে। মেয়েটি প্লেনে উঠে নতুন শহরে রিলোকেট করতে করতেই ভাবছিল যদি প্রাক্তন সম্পর্কটাকে একটু বোঝাবুঝি করে ঠিক করে নেওয়া যেত, যদি সে শেষ বেলায় এত ঝগড়া না করত তাহলে হয়ত সব ঠিক হয়ে যেত, প্রেমিকের মিসোজিনিস্টিক সমস্যা গুলোকে ছোট করে দেখে যদি সামগ্রিক বিগার পিকচার টা দেখত তাহলে ম্যাডেনিং ঝগড়া, ছাড়াছাড়ি, শহর ছেড়ে পালান কিছুই দরকার পরতনা। তারপরেই নিজের দুর্বলতার উপর অসম্ভব রাগ হয়েছিল তার। মনে হয়েছিল অনেক অনেক সস্তার হুইস্কি খেয়ে সারারাত বমি করলে হয়ত এই ওভারহয়েল্মিং দুঃখ কিছুটা কমবে। 
যদিও শূন্য দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যেতে যেতে তার এইসব কিছুই মনে আসেনি। 

রিংপচে দুটো স্বপ্ন প্রায়েই দেখত। একটায় সে সত্যিকারের দুঃখ, রোগব্যাধি, দারিদ্র, জরা জয় করে এক ইউটপিয়া তৈরি করেছে। অন্যটি হল সে এক পাহাড়ের গুহায় অন্ধকারের সাথে মিশে যাচ্ছে, শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে পেছন ফিরে গুহা থেকে পালাতে পারছেনা। বেগুনী আভার দিকে হেঁটে যেতে যেতে তার মনে হল আজ হেস্তনেস্ত হবে। আজ এস্পার নয় ওস্পার। মৃত্যু বা নতুন কিছু।

পাহাড় ফাঁক হয়ে এক অজানা পৃথিবী দেখা যাচ্ছিল। রিংপচের আশপাশ দিয়ে দলেদলে রেড পাণ্ডা নিঃশব্দে সেই দুনিয়ার দিকে চলে যাচ্ছিল। নতুন পৃথিবীর অস্পর্শিত, অচেনা, গাছপালা, মাঠ, নদী, পাহাড়, পশুপাখি, রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ এক অবর্ণনীয় আনন্দে ভরিয়ে তুলল রিংপচেকে। 
সে অস্ফুটে বলে উঠল, 
"বে-ইয়ুল! সাংরি-লা!"
তিরিশ ফুট গাছগাছালি ভেদ করে অক্ষত অবস্থায় মেয়েটি মাটিতে পৌঁছে, অপ্রকৃতিস্থতা, অসম্ভব হাতপা কাঁপা আর অ্যাড্রিনালিন রাসের অগ্নুৎপাত কাটিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল এক সম্পূর্ণ অচেনা সভ্যতা তার চোখের সামনে। ছেলেটি সারা শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে হেলিকপ্টারের খোলা দরজা দিয়ে একটি মাত্র অক্ষত চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখল তারা পার্ল হারবার থেকে নক্ষত্রবেগে পালাচ্ছে, এমন এক সভ্যতার দিকে যা সে বহুদিন হল ভুলেই গ্যাছে।

Tuesday, October 2, 2018

কভেন

রোহনের দাদু যেদিন মারা যায়, সেদিন দিদিমা সারারাত একফোঁটাও কাঁদেনি। সারারাত বৃষ্টি মাথায়, নতুন থানে, গোল গোল চোখ করে পুকুরপাড়ের নিম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে 'মার্গারেটের' সাথে কথা বলেছিল। ওদের বস্তিতে সচ্ছল গৃহস্থ কেউ মারা গেলে রাজকীয় দাওয়াত বসে, ব্যান্ডপার্টি ভাড়া করে দেহ নিয়ে পরমানন্দে প্রসেশান বেরোয়, পাপের জীবন শেষ হওয়ার দিন।
আগেরদিন রাতে জব্বর খাওয়া হয়েছিল। ভোররাতে জলতেষ্টা পেতে উঠে দেখে, দিদিমা স্টোভ জ্বালিয়ে উঠোনে বসে চা করছে, পাশে আরামকেদারায় দাদু বসে আছে, ঠিক তেমনটা দেখতে যেমনটা কিনা তার প্রথম স্মৃতি দাদুকে নিয়ে। কালো উনুনের মত রং, লম্বা জুলফি, হাতে ক্যাপ্সটান সিগারেট, খালি গায়ে লুঙ্গি পরে, ঠিক যেন দশ বছর আগের দাদু। মুখখানা কিরকম ঘষা কাঁচের মত, চারিদিকে কড়া চাঁদের আলো। দিদিমা বলেছিল, চেনা তাদের যে মানুষটে চোখ ফেলে দেখে, তার মনে ধরা সেই লোকটির প্রথম আনন্দের ছবিটেই দেখতে পায়।
দিদিমা দুঃখী ফোকলা হাসি নিয়ে কতই সে গল্প, দাদু মলিন মত, চোখ দিয়ে কথা বলে। দিদিমা বলেছিল, মাজার জোর ছিল বলে এলেন উনি, নাহলে মার্গারেটের বাবাও আনাতে পারতেন না। আহা গো, সদাশিব মানুষ ছিল।
সেদিন থেকে রোহন বুঝেছিল, দিদিমার জগতটা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা এবং তার সাথে সাথে, হয়ত তারও।

কয়েক সপ্তাহ আগে বিলের থেকে গোসাপ এসে হাঁস খেয়ে যেত বলে দিদিমা ভোররাতে উঠে বাঁশ পিটিয়ে দুটো গোসাপ মেরেছিল। একাই। এই বয়েসেও।
তারপর মৃতদেহগুলিকে ঘরের দাওয়ায় রেখে সে কি কান্না। রোহন শান্ত হয়ে পাশে বসেছিল। তারপরে গরম জলে গা মুছিয়ে পুকুরপাড়ের নিম গাছের তলায় রেখে এলেন। পরের দিন বিকেলে খেলে ফেরার সময় রোহন মিন্স দুটি নীল গোসাপ দেখেছিল। সরসর করে ঝোপ পেরিয়ে বিলে নেমে যাচ্ছে। দুরে দিদা দাঁড়িয়ে। বাটি তে বাসি ভাত।

দিদিমারা পাঁচ বোন ছিলেন, থাকতেন সুন্দরবনের নামহীন এক প্রত্যন্ত গ্রামে, পাথরপারায় এসে শুঁটকি করার কাজ করতেন সবাই মিলে। দাদুর বাড়ি ডাঙ্গায় গিয়ে আরও চল্লিশ মাইল পরে, ডায়মন্ড হারবর থেকে ঠিকে জাহাজে মাল নিয়ে কলকাতায় নামাতেন। কি করে জানি দেখা হয়ে গ্যাল। যদি জাহাজই ডুববে তাহলে চরে এসে দিদিমা শুঁটকিই বা করে কেন আর যদি জাহাজই না ডুবল তাহলে কিই বা আর হল?
দিদিমার কাছে গ্রাম থেকে আনা অনেকরকম দেবদেবীর পুতুল ছিল, শঙ্কর মাছের লেজ, অনেক রকম সামুদ্রিক পাথর, বিভিন্ন রকম গন্ধওয়ালা হাবিজাবি ওষুধের শিশি, শকুনের একগোছা পালক। দিদিমা কালো কাঠের বাক্স করে খাটের তলায় রাখতেন। সেইঘরে একটাও যীশু ছিলনা। দিদিমা চার্চেও যেতেন দু মাসে একবার। তখনই, যখন  গ্রামে কোন পারিবারিক অনুষ্ঠান হত।

মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, তিনিও বেশ অনেকখানি পাগলি ছিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছের সাথে কথা বলতেন। দিদিমা আর মা দুইয়ে মিলে মাসে একদিন পাশের গ্রামে যেতেন, বাড়িতে জানাতেন কোনও আত্মীয়ের বাড়ি যান। কে বা কারা রোহনের বাবা আর দাদু অত পাত্তা দিতেন না। বরং এই সুযোগে তারা পাড়ার কাকুদের জুটিয়ে বোতল খুলতেন। ঝামিরা ঘটকপুকুর থেকে চর্বিওয়ালা শুয়োরের মাংস এনে ঝাল করে কষাতো।
রোহন জানত আত্মীয়ের বাড়িটা অজুহাত মাত্র।
আসলে তার মা-দিদিমার মত আর কেউ কেউ আছে, যারা জল বাঁকাতে পারে, মরা জাগাতে পারে, পশুপাখির মন বুঝতে পারে, বৃষ্টি হলে কতক্ষণ হবে বলতে পারে, মার্গারেটের মত দেড়শ বছর আগে বিলের ধারে যারা ফোরট বানিয়ে থাকত তাদের সাথে কথা বলতে পারে, নিম গাছের মধ্যে যে দরজাটা দিয়ে সেই উল্টো দুনিয়াটায় যেতে হয় তারা জানে। তারা বনবিবি দেখেছে। মা-দিদিমা তাদের কাছেই যান। সুখদুঃখের গল্প করতে।
রোহন এখন বড়ো হয়ে এটাও বুঝে গ্যাছে যে মা-দিদিমা এইসব পারলেও তার নিজের জগতটা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা না।
সে নিজে এই ক্ষমতা গুলি জন্মায়নি। 

Friday, December 8, 2017

লেত্তি

The Tryst of Letti
- Chaiti Nath, Jan 2017



                                                                (১)

অফসাইডে চারজন ফিল্ডার। তারমধ্যে কভারে বাঘের মত ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে আছে সুমিত। ফরওয়ার্ড শর্ট-লেগে সুমিতের ভাই ভিকি। বাবা-মা ইন্টারকাস্ট বলে দুই ভাই কে পাগড়ি দেননি। কলকাতায় মার্চের চামড়া জালানো গরম। রক্ষে করেছেন।
আলমদের ছোটছেলে বল করবে। লুঙ্গি আর নকল অ্যাডিডাসের ছাইরঙা টিশার্ট। খালি পা। চুইং-গাম চেবাতে চেবাতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কোমরের নিচে অদৃশ্য হাতের কব্জি থেকে সাপের ছোবলের গতিতে ছিটকে দুশ গ্রামের প্লাস্টিক-বল স্পেস-টাইম ডিস্টরট করতে করতে ড্রপ খেলো গুড-লেংথে। আমার কানের পেছনে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম, আগের দুটো বল এত জোরে ছিল না। আগের দুটোই লেগ স্পিন ছিল, একটা ক্যাচ হতে হতে চার হয়ে গ্যাছে, আরেকটা ফ্লাইট মিস করে উইকেট-কীপারের হাতে গ্যাছে। ঠ্যাং বাড়িয়ে কভার আর সোজা সটের মাঝখানের স্পেস টা নেব ইতিমধ্যেই বল সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে আমার মিডল স্টাম্প ছিটকে দিয়েছে। ইসস, বোঝা উচিত ছিল। আরহান খুবই আনপ্রেডিক্টেব্ল। চারিদিকে সবার পাশবিক উল্লাস, ম্যাচ ওদের হাতের মুঠোয়। রানার্স এন্ডে সানি। যে কিনা এখনো দুধভাত পর্যায়ের। লাস্ট ম্যানের ব্যাটিং আছে। সে আউট হলেই শেষ। বাকি চার বলে বারো রান। জেতার আশা প্রায় নেই।
জগুন চিৎকার করে বললে, 'বোলা থা না, ইশকো উপার ভেজ, উসকো সেট হনে মে টাইম লাগতা হ্যাঁয়!'
কথাটা সত্যি। আমি অত্যন্ত নার্ভাস জাতীয় প্লেয়ার। আর আজ আমার মনে হচ্ছিল, লিফটের অ্যাটিক থেকে দেওয়াল ভেদ করে লেত্তি আমায় দেখছে। কেউ আমায় দেখলে আমার আরও হাঁটু কাঁপে।
লেত্তির চোখগুলো আমি কক্ষনও দেখিনি। মানে, ওর কপাল থেকে ঠোঁট অব্দি কিরকম একটা নিঝুম অন্ধকারে ঘেরা।

বয়েস চোদ্দ, পড়াশোনায় ভালই। আর পাঁচজনের মত গিটার বাজাতে, ছবি আঁকতে পারতাম।
কয়েক সপ্তাহ আগেই বার দুয়েক জন্ডিস হয়েছে, বিলিরুবিন ভীষণ বেড়ে বিছানার চাদর অব্দি হলুদ হয়ে যাচ্ছিল। শরীর এখনো দরের হয়নি। দিনের পর দিন পেঁপে আর মাগুরমাছ খেয়ে মানসিক ভাবেও অত্যন্ত দৈন্যে ভুগেছি।
মাঝখানে আবার আলমদের বড়ছেলের বিয়ে ছিল। বেলিয়াসোর থেকে তিনখানা ডাইনোসরের সাইজের দুম্বো ওদের বারান্দায় রাখা ছিল। ওদেরকেই হালাল করে, ম্যারিনেট করে বিরাট ডেকচিতে বিরিয়ানি হয়েছিল। লখনউ থেকে বাবুর্চি এসেছিল।অজস্র কাবাব আর সরের ময়ান দেওয়া লাচ্ছা পরটা। চাল-ক্ষীরের ফিরনি। মেওয়া দেওয়া সীমাই। মিঠা ভাত। আমাদের ফ্লাটের উলটোদিকেই। গন্ধে মনে হচ্ছিল এইসব না খেতে পাওয়ার থেকে মরে যাওয়াই অনেক ভাল। আলমরা আবার প্র্যাক্টিকাল জোক করেছিল আমার সাথে। বলেছিল দাওয়াত পে আইয়ে, পেপে-কা বিরিয়ানি বানায়েঙ্গে আপ কে লিয়ে!
                                                               (২)

দু মাস বিছানায় শুয়ে কিছু করার থাকত না। ছোটমামা আর তার বান্ধবী আমাকে প্রতি সপ্তাহে বই এনে দিত। তখনই জুলভারনের অমনিবাসটাও পরেছিলাম। শুরুতে অসম্ভব ভাললাগছিল। কিন্তু বাধসাধল প্যাসিফিকের কোন
এক নাম-না-জানা দ্বীপে বন-শুয়োর শিকার করে এনে আগুনের মশলা দিয়ে ঝলসে খাবার ডেস্ক্রিপ্সান পড়েই (টয়েন্টি থাউস্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী)। তখন একটু শরীর সেরে আসছিল, একঘেয়ে খাবার খেয়ে খেয়ে হঠাৎ একদিন মনে হল, আর না!
মনে পরল বাবা বলেছিল, সর্বহারারাই বিপ্লব করতে পারে। আমি এখন প্রকৃত অর্থে সর্বহারা। আলমদের বিয়েবাড়িটা মিস করাটাই থ্রেশহোল্ড ছিল।

ওঠা বারণ, পা টিপে টিপে উঠলাম। শীতের রাত। ফ্রিজে নলেন গুড়ের টিন। গুছিয়ে পাউরুটি নিয়ে সোফায় বসে কম ভল্যুমে টিভি চালালাম। পোকেমনের রিপিট টেলিকাস্ট। খাবার শেষ হতেই কেবল কেটে গ্যাল। জানলায় গিয়ে বসলাম। ঠাণ্ডা হাওয়া। পাঁচতলার জানলা দিয়ে পুরো এলাকাটাই দেখা যায়। নস্করপাড়া, একটু দুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গেট পেরিয়ে জংগুলে মত জায়গা, বন বাদাড় পেরিয়ে গঙ্গা, গঙ্গায় আবছা কিছু আলো কুয়াশা কেটে ভীষণ মন্থর গতিতে এদিক অদিক  করছে, কারখানার ধোঁয়ায় আকাশ শ্যাওলাটে।
আমাদের এপার্টমেন্ট টপ-ফ্লোরে , ছাদ থেকে হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠলাম। একবার মনে হল কাটিয়ে দি, দেখলাম বাবা-মা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। নিনজা মোডে কল্যাপ্সিবল খুললাম, পালকের হাতে ছাদের গেট,
সামনেই দিগন্ত বিস্তৃত ছাদ, যেখানে অসুখ হওয়ার আগে অব্দিও রোজ বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে বল পেটাই।
ছাদে উঠতেই সেই একনাগাড়ে দুমদাম শব্দ। আসছে লিফটের যন্ত্রের একফালি ঘরটা থেকে। একবার আগে একটা শকুন এসে আটকে পরেছিল এইখানে। দরজা খুলে বের করতে গেলে রাগী রাগী চোখে তাকাচ্ছিল আর ভিকি বলেই যাচ্ছিল ঠুকরে চোখ খুবলে নেবে।
দরজা খুলেই হাঁহাঁ করা অন্ধকার, আর হাই-ভোল্টেজ ইলেক্ট্রিসিটির একটানা শব্দ। লিফটের আসা যাওয়া এত রাতে হয়না বললেই চলে। হলেও এরকম দরজা ধাক্কানোর মত শব্দ হয়না। ভেতরে ঢুকে কোনরকম শব্দের কারণ খুঁজে না পেয়ে পেছন ফিরতেই হঠাৎ 'দুম' করে খুব কাছেই যেন কোন ভারী বাক্স দোতলার বারান্দা দিয়ে মাটিতে এসে পরল। হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা লাগল। হয়ত আবার জ্বর আসছে। ভয়ে গলাটা শুকিয়ে গ্যাছে। কোনরকমে থুতু গিলে পেছন ঘুরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েও কিছু দেখতে পেলাম না।
দরজা বন্ধ করে কোনরকমে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মনে হল দেওয়াল দিয়ে যেন চাপা গুমগুম শব্দ আমার পিছুপিছু নামছে, সেই সঙ্গে মিশকালো ঠাণ্ডা এক ঝলক বাতাস। অজানা এক আতঙ্কে আমি ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই শব্দ পিছু নেওয়া বন্ধ হল। সারারাত ঘরের আলো জ্বালিয়ে মরার মত পড়ে থাকলাম, ভাল ঘুম এলো না।

                                                             (৩)

পরদিন দুপুরে টুমনা এলো সাপ্তাহিক স্কুলের কাজ আর সিলেবাস নিয়ে। মা ওকে গরম গরম কপির সিঙ্গারা ভেজে দিল, আমায় দিল মশলা ছাড়া অল্প তেলের চিঁড়ে ভাজা। ওকে আগের দিনের ঘটনা জানালাম সংক্ষেপে,ও হাঁ করে শুনল। বলল একদিন রাতে এসে থাকবে যদি এমনি চলতে থাকে। দুজন মিলে অবসারভ করব। টুমনা এমনিতে খুবি ডাকাবুকো, ফুটবল খ্যালে তাই লম্বা বিনুনিটা গত বছর ত্যাগ করেছে। বড় বড় চোখ।
পর পর আরো দুরাত রোজই শব্দ শুনতে পেতাম, আর কেউ পায়েনি। মা-বাবা না, খেলার বন্ধুরাও না। আমিও ঘর থেকে বেরইনি।
তৃতীয় দিন কষ্ট করে স্কুলে গেছিলাম সাজেশান আনতে। হাঁটলে পেটে লাগত।
আমাদের এক বহু বছর আগের পাস-আউট  সিনিয়ার ছিল, স্কুল ছাড়ার আগে আগে সে নাকি স্কুলের পেছনের জঙ্গলে একটা নীল গোসাপ দেখতে পেয়েছিল। তারপর তাকে ধরতে গিয়ে গঙ্গায় পড়ে যায়, সেই থেকে পাগল হয়ে স্কুলের মাঠেই পড়ে থাকে। একেবারেই ভায়লেন্ট না। বরং ছেলেদের সাথে ফুটবল খ্যালে, টিফিন ভাগ দিলে খায়। আমার সাথে ভাল করেই কথা হত তার। আমাকে একবার বলেছিল গঙ্গার তলে সে নাকি পানিমুড়া দেখেছে। যারা অভিশপ্ত জলে ডুবে মরে তারা পানির মধ্যে পানিমুড়া হয়ে থাকে, তাদের মাছের মত কানকো আর পাখনা গজায়।
বিষ্টু পাগলা আমার গল্প শুনে বলল, 'যদি ভয় না পাস তাহলে, যে তোকে শব্দ করে ডেকেছে তাকে তুইও আওয়াজ করেই সাড়া দে। '

সেদিন রাতে যেন বাঁধনহারা শব্দ, মনে হল দুনিয়া সুদ্ধু সবাই এখুনি জেগে যাবে। আসে পাশে কেউ যেন হাতুড়ি মেরে মেরে দেওয়াল ভাংছে। উঁকি মেরে দেখলাম মা-বাবা ঘুমে অচেতন, যেন ঘরের মধ্যে কুয়াশা। মন হল পৃথিবীতে এমন কিছু আছে যেগুলোর ভাগ আর কেউ নেবে না। উপলব্দি গুলো আমারই। একার। দরজা খুলে লিফটের ঘরের সামনে এলাম। দরজা যেন শব্দে ফেতে পড়তে চায়। অসম্ভব ভয়ে হাত পা হিম হয়ে যাচ্ছে। সাহসে ভর করে অত্যন্ত আস্তেআস্তে দরজায় টোকা দিলাম। হঠাৎ নৈশব্দ। প্রতিটা মিনিট কাটতে লাগল ভীষণ আস্তেআস্তে। চাঁদের আলোয় চারিদিক সাদা। প্রতি মুহূর্তে যেনও ঠাণ্ডা বেড়েই চলেছে।
হঠাৎ সবকিছু তোলপাড় করে দেখলাম কার্নিশ থেকে উল্টো হয়ে একটি সবুজ সালওয়ার পরা মেয়ে আমার দিকে দেখছে। মাথার চুল লম্বা হয়ে মাটিতে এসে ঠেকেছে। ভয় হাত-পা কাঁপছে, স্নায়বিক চাপে হয়ত অজ্ঞানই হয়ে যাব।
মেয়েটি হাওয়ায় ভেসে ভেসে শম্বুকগতিতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠাহর করে দেখলাম লিকলিকে হাত-পা, খুবি পুরনো সালওয়ার, চোয়ালের হাড়গুলো উঁচু উঁচু, চোখ দুটো দেখা যায়না, কপালের নিচে যেন নির্নিমেষ অন্ধকার। মেয়েটি যেন ঘষা কাঁচে তৈরি।
 

                                                            (8)

যখন চোখ খুললাম তখন সকাল সাড়ে দশটা । তারপর থেকেই লেত্তি প্রায়েই গভীর রাতে ঘরে আসত, ওইরকম ভাবেই, উল্টো হয়ে জানলা দিয়ে। মাথার কাছে এসে বসত। কখনো কথার উত্তর দিত, কখনো  দিতনা।  বাংলায় কথা বলত।
বলেছিল আগে নাকি ফ্ল্যাটের পাশের খবরখানা টা আসে পাশের আধ কিলোমিটারেরও বড় রেডিয়াস ধরে ছিল। পরে মাটি ফেলে কারখানা, ফ্ল্যাট বাড়ি আর রাস্তা  হয়। আগে যখন আসে পাশে মুসলমানদের গ্রাম ছিল, সব উজাড় হয়ে যায় কলেরায়। তখন কবর খানা বাড়তে বাড়তে এদিকে ছাপিয়ে চলে আসে। হিসেব মত লেত্তির কবর আমাদের ফ্ল্যাটের লিফটের গর্তের নিচে। গ্রাউন্ড ফ্লোরেরও নিচে, বেস্মেন্টের গ্যারাজেরও নিচে। লিফটের ছোট্ট গর্তের নিচে। লেত্তি কিন্তু কলেরায় মরেনি, গ্রামের পারে, কবর পেরিয়ে বেঁটে বেঁটে গাছের জঙ্গলে আদিবাসীরা ফাঁদ পেতেছিল শজারু ধরার জন্যে, একটা নীল গোসাপ কে তাড়া করতে করতে ফাঁদে পড়ে অত্যধিক রক্তপাতের কারণে তার মৃত্যু হয়।
পরে বড় হয়ে ভেবেছি তাকে নামাজের সময় দেখা যায়নি কক্ষন। টিভির ঘরের জানলার বাইরে গোধূলির আলোয় ওকে কার্নিশে ঝুলতে দেখেছি। ও বলত ওর দুনিয়টা আমাদের মতই দেখতে, কিন্তু উল্টো। আমার কোনদিন ক্ষতি করেনি, সপ্তাহে এক দুবার আসত। ভয়টা কেটে গেছিল।
 

ক্লাস টেনের পরে আমরা সপরিবারে দিল্লী চলে যাই। দিল্লীতে কক্ষন লেত্তিকে দেখিনি। খালি নিজামুদ্দিনের দরগায় একটা ফকির আমার মাকে বলেছিল আমার মাথায় জীনের ছায়া আছে।





















Tuesday, November 28, 2017

মুসল্লাহ

একটা প্রজেক্টের শুরু থেকে মাঝপথ অব্দি এই নিয়ে তিনবার ওডিসি চেঞ্জ হল। এমনিতে কোনো অসুবিধা নেই। এনএসএস লোকেরা এসে রাতের বেলা সিপিউ তুলে নিয়ে নতুন সিটে লাগিয়ে দ্যায়, সোমবার সকালে গিয়ে প্রথম কাজ হয় গোলকধাঁধার মত অফিস ফ্লোর ঘুরে নতুন সিটটা আবিষ্কার করা।
রেফ্রিজারেটেড আবহাওয়ায়, আর্টিফিশিয়াল সিলিঙের নিচে সবই একরকম লাগে। ছোটবেলায় স্কুলের গেট থেকে গঙ্গার পাড়ের ঝোপঝাপড়া অব্দি একা একা ভাঙ্গা ডাল নিয়ে গোসাপ খুঁজে বেড়াতাম, আই গেট লিটল ফাজি ইন মাই হেড ইন আ ফর্মাল অ্যাটমস্ফিয়ার। 

টেবিলটা নোংরা করে রেখেছিলাম একগাদা অ্যাকশান ফিগার, ববলহেড, বই আর সফটবোর্ডে গোছা
গোছা পপকালচারের পোস্টার ইত্যাদিতে। মাঝে মাঝে ছিঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হত। ইচ্ছে হত ম্যানেজারের গালে ঠাশ করে একটা উল্টো হাতের চড় মেরে বলি 'ইয়ার্কি হচ্ছে গুদ্মারানির ব্যাটা?', কিন্তু পারতাম না। মাস গেলে তিরিশ হাজার বাংলা অনার্স পরলে পেতাম কি? হয়ত না, কারণ আমার সেরকম যোগ্যতা ছিলনা।    
সময় নিয়ে বাক্সে ঢোকালাম, কফি বানালাম। সপ্তাহের সবচেয়ে কড়া কাপ। তারপর খাঁচায় বন্দি বাঘের মত অ্যাঙ্গজাইটি অ্যাটাক খেতে খেতে নতুন ওডিসি খুঁজতে বেরলাম। অবশ্যই হেডফোন লাগিয়ে, কারণ সোমবার সকালে সাড়ে দশটার সময় কেউ খেজুর করতে এলে তাকে খারাপ ভাবে খুন করে দিতেও আমি দুবার ভাবব না। সিয়াচেনে বাঙ্কারের বাইরে যেমনি কেউ বুলেটপ্রুফ না পরে মুততেও যায়না, তেমনি হেডফোন না লাগিয়ে আমি এমনি কোথাও যাইনা যেখানে আমাকে মাথার মধ্যেকার যুদ্ধ ছাপিয়ে কারুর সাথে স্মলটক করতে হবে। দিনের পর দিন দু-একটা সিলেবেল বাক্যালাপ করে কাটিয়ে দিতে পারি। কিন্তু মাল্টিভেন্ডার মেল-কমিউনিকেশান করার সময় আমি রাজা। চ্যাটবক্সে আমি সাতাশের গ্রেগরি করসো। সামনাসামনি মুখ ফুটে কথা বলার সময় আমার থেকে বেশী অসহায় বোধহয় আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে।  
নতুন ওডিসিটা কাছেই আর রাস্তাঘাটে কারুর সাথে কথা বলতে হয়নি দেখে খুশিই হলাম। সিটের আশেপাশে চেনাশোনা কেউ নেই। ডেস্কের ড্রয়ারটা খুলে দেখলাম সিটটি অনতিপূর্বে অন্য কারুর ছিল এবং সে ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সহকারে অধিকাংশ জিনিস ফেলে রেখেই চলে গ্যাছে।
কোম্পানির প্রোটকল অনুসারে আমাকে অ্যাডমিনে ফোন করে ডেস্ক ক্লিয়ারেন্সের ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করতে হত কিন্তু অফিসের কাজে মন ছিলনা আর হাতে সবসময়ই আমার অনেক অনেক সময়। অতলস্পর্শী ডেস্ক থেকে সমস্ত জিনিস বের করে কোলে রাখলাম। আলপটকা ক্ল্যারিক্যাল জিনিস ছাড়া আর ছিল একটি মুরাকামির নভেল আর একটি মুসল্লাহ। 

তারপর, যেটা আমি গত দুই বছরে করিনি সেটাই করে ফেললাম। কিউবিকলের পাঁচিল টপকে অচেনা লোকটিকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম এখানে আগে কে বসত।
- অ্যাম নট শিওর, মোস্ট প্রবাবলী শিরিন। লাস্ট নেম মনে নেই। ক্যান? কিছু দরকার?
বোকা খেজুরের গন্ধ পেয়ে ভায়লেন্টলী এরালাম কথাবার্তা।
তারপর আউটলুকে খুঁজতে বসলাম। অফিসে সবমিলিয়ে সাতান্নটি শিরিন, তারমধ্যে কলকাতায় আটটি। সবার কন্ট্যাক্ট কার্ড বের করলাম, তারপর ভেসে গেলাম। তিনজনকে ইন্সটিঙ্কটিভলী বাছাই করে কমুনিকেটারে লিখতে গিয়ে দেখি কিছুই কাজ করছে না। লাঞ্চে নিউজ চ্যানেলে দেখলাম চেন্নাই ভেসে গ্যাছে বন্যায়। সব মিলিয়ে সতেরোটা বিল্ডিং চেন্নাইতে কোম্পানির, মেজর সার্ভারস গুলো ওখানেই। তাই হয়ত দেশজুড়ে টেকনিক্যাল ইস্যু।
অফিস থেকে বেরলাম অসম্ভব জ্বালা নিয়ে সারা শরীরে। যেন জীবনই ব্যর্থ শিরিনকে খুঁজে না পেলে। রাতে ঘুম এল না। জেগে জেগে ভাবলাম কাল যদি আউটলুকের সমস্যা মেটে তাহলে কালই রহস্যের পর্দা উত্তোলন। সকালে উঠে জীবনে প্রথমবার অফিস যাওয়ার জন্যে পেটের কাছে হাল্কা উত্তেজনা অনুভব করলাম। 
অফিসে গিয়ে দেখি চেন্নাইয়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টায়। মেল সার্ভারস মায়ের ভোগে। অর্থাৎ আমার কোন কাজই হল না। পুরো দিনটি কাটল কপালের উপরে একটা কালো ছায়া নিয়ে।
হঠাৎ মাথায় এল, মেয়েটি যদি মুসলিমই হয় তাহলে সে রিলিজিয়াস। নাহলে অফিসে নামাজ পরার কাপড় আনত না। তারপর থেকে প্রতি নামাজের সময় যোহর থেকে ঈশা অব্দি মেয়েদের প্রেয়ার রুমের সামনে ঘুরঘুর করতাম। গোটা চারেক মহিলা সবথেকে বেশী ফ্রিকয়েন্ট ছিল। তিনদিনের মাথায় বুঝলাম আমার দ্বারা নিজে থেকে গিয়ে কথা বলা সম্ভব না। তারপরই ভাবলাম যদি সে রিলিজিয়াস হয় তাহলে মুসল্লাহ ফেলে যাবেই বা ক্যান? হয়ত এটি তাকে পরিবারের কোন শুভাকাঙ্ক্ষী দিয়েছিল, সে নির্মম আনগ্রেটফুল , তার তাতে কিছু যায় আসে না।
রাতে অসম্ভব মদ গিলে বাড়ি ঢুকলাম। ফ্ল্যাটমেট পাশের ঘরে মেহেদি হাসান চালিয়েছিল।

जैसे तुम्हें आते हैं ना आने के बहाने
ऐसे ही किसी रोज़ न जाने के लिए आ
খুব কান্না পেল। সিঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কাঁদলাম। সাত বছরে অমন কাঁদিনি। হাল্কা লাগল। ঘুমালাম শিশুর মত।

পরদিন বৃষ্টি ঠেলে অফিস এসে দেখলাম মেল, কমিউনিকেটার সব দাঁড়িয়েছে। পরমানন্দে খুঁজে বের করলাম সেই তিনজন কে। দুজন ম্যানেজার লেভেলের, নরম্যাল কিউবিকলে বসবে না। পড়ে রইল ওই এক। দেখলাম
কমিউনিকেটারে তার উপস্থিতি আননোন। মানে সে বিদেশে বা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ধুক করে বুকের ঘোড়াদৌড় বন্ধ হয়ে গ্যাল। আশার মুখে পেচ্ছাপ।
শুরু করলাম সোশ্যাল নেটওয়ার্কিঙে খোঁজা। শুধুমাত্র একটি ভীষণ কমন নাম নিয়ে খুঁজে পাওয়ার আশা প্রায় নেই বললেই চলে। দিন দুয়েক সারাদিন ইন্টারনেটে বসে বসে অবসাদে প্রায় না খেয়ে না স্নান করে অসুস্থ হয়ে পরার উপক্রম হল।
আজ অফিসে গেলাম, পাশের ডেস্কের দাসবাবু বললেন একটি বুরখা পরা মেয়ে এসে আমার ডেস্কে ওর জিনিস খুঁজছিল,ডেস্কে চাবি আর ডেস্কে আমায় না পেয়ে বলে গ্যাছে লাঞ্চে আবার আসবে।
কোমরে তীক্ষ্ণ ব্যথা হতে লাগল, হাঁটু দুটো একে ওপরের সাথে ঠোকা লাগছিল, কানের কাছটা গরম লাগছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে শিরিনের বাক্সটি দাসবাবুর জিম্মায় দিয়ে বললাম 'দিয়ে দেবেন'।
- একি, কোথায় চললে?
- শরীর ভাল নেই।
সোজা হেঁটে বাইরে এলাম। সিগারেট ধরালাম। বাস স্ট্যান্ডে এসে দক্ষিনের বাসে উঠলাম। ঈশ্বর পেয়ে গেলে মানুষ নির্লিপ্ত হয়ে যায়। নির্লিপ্ততাই বরং থাক। ঈশ্বরের সাথে কথা বলার সোশ্যাল স্কিল আর যাই হোক আমার নেই।

 
















Monday, November 20, 2017

কতগুলি দরজা-জানলা মিলে একখান লাহোর শহর হয়?

ওয়াকাড়ের বাস স্ট্যান্ড থেকে একটু এগিয়ে বিপজ্জনক ভাবে শিবনেড়ি বাসের গা ঘেঁষে স্টেশনগামী সাটলটা দাঁড়াল। বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছে। শ্বেতার গায়ে ভারি রেইনকোট। শীতের আরামে প্রায় ঘুমন্ত, গলা অব্দি মদ্যপ। চোখের পাশে কান্না শুকিয়ে লেগে আছে। এলোমেলো চুল। সরোজিনী, পালিকা বাজারের কলেজের বন্ধুরা তাকে হয়ত আজ অব্দি কক্ষনও এত ডি-গ্ল্যাম দ্যাখেনি।
- 'ম্যাডাম কাঁহা উতরনা হ্যাঁয়?'
- 'হাঁ...?'
সম্বিত ফিরে পেয়ে খেয়াল হল, চক পার হয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার চলে এসেছে। পার্সে এক-দুশ টাকা আছে। আর এক সপ্তাহ অফিস করলে পর মাইনে আবার। তদ্দিন চালাতে হবে।
একটা কুড়ির মারলবোরো অ্যাডভান্সডের থেকে দু তিনটে ছাড়া বাকিটা ব্যাগে আছে। একটা ওল্ড মঙ্কের পাঁচশর টু-থার্ড পড়ে আছে। একটা আধখাওয়া খাখরার প্যাকেট, একটা কার্ল ব্রাশ, ব্লুটুথ স্পিকার আর পঁচিশরকম হাবিজাবি জিনিস সরিয়ে কুড়ি টাকা বের করার পর দেখা গ্যাল, খুচরোর খাপে এক সেট ডোর-কি।

সাটলটা বেরিয়ে যেতেই চাবিটা রাস্তার উপর থেকে খান্দালার পাহাড়ের দিকে লক্ষ করে সে সর্বশক্তিতে ছুঁড়ে মারল, সেই সঙ্গে গাড় পাঞ্জাবী অ্যাক্সেন্টে কিছু অস্ফুটে গালি। তারপর কিছুক্ষণ কসরত করে, ঢাউস সাইডব্যাগ, চল্লিশ লিটারের রাক্স্যাক আর প্রকাণ্ড ট্রলি টেনে বৃষ্টি মেপে হিঞ্জেওারি সেজের দিকে হাঁটা দিল। বেশ খানিকটা পথ। কিন্তু অটোরিক্সা রাত দুটোয় দুশ হেঁকে দেবে। তার চেয়ে টলতে টলতে হাঁটা ভাল। 

পশ্চিমদিক থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া সেপ্টেম্বরেও হাড়ে কনকনানি লাগিয়ে দিচ্ছে। নক্ষত্রবেগে ভুসোকালি মাখা ট্রলার বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কয়েকটা চা-সিগারেট-বড়াপাওয়ের টপরি খোলা আছে। আশেপাশের কয়েকটা অফিস খোলা এখনো। মাইন্ডট্রির সামনে থেকে বাঁদিক নিতেই দুটো বাইকওয়ালা পিছন দিয়ে এসে অতর্কিতে গাড়ি থামিয়ে, 'ম্যাডাম হেল্প? ম্যাডাম লিফট চাহিয়ে?...'  
কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ভীষণ অসহায় লাগার পর শ্বেতা হঠাৎই লক্ষ করল তার পেটের মধ্যে কোনো আন্সটেবল তরল কয়েক হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ফুটছে। এপিডারমিস দিয়ে ধোঁওয়া বেরচ্ছে,  কানের পেছনদিকটা লাল। বৃষ্টিতে, ঘামে চুল জড়িয়ে আছে কপালে। জেগিন্সের পেছনে নাড়া থেকে খাটো কৃপাণটা বের করে লাল চোখে প্রথম বাইকওয়ালার সামনে নাচিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
-'ইয়ে দেখা হ্যাঁয়? পিছওয়াড়ে মে ঘুসা দেঙ্গে বায়েঞ্চ...' 

টাওয়ারের তলায় যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় তিনটে বাজছে। প্রডাকশান উইকে লেট-নাইটস খুবই নরম্যাল।
ফোনটা শেষবার দেখেছিলাম যখন, তখন সাড়ে আটটা, শ্বেতার প্রায় পঁচিশটা মিসড কল ছিল। আজকাল এরকম প্রায়েই হয়। নোংরা ব্রেকআপ আর ভিন্ডিক্টিভ রুমমেট, দুটো নিয়ে সারাদিন কুস্তি করে, সূর্য ডুবলেই রাম নিয়ে বারান্দায় বসে যায়। নাহলে শহরে কোন নাম না জানা পাবে। তখন সে অন্যই মানুষ। ধীরে ধীরে নেশা বাড়লে সে মাঝে মধ্যে আমাকে ফোন করে। হিন্দি-পাঞ্জাবি-ইংরিজি গুলিয়ে যায়, হাহা করে হাসতে থাকে সে এবং তারপরে ফোন ধরেই পাস আউট করে যায়। 


ঘরে ঢুকতেই দেখলাম রোহন ডাইনিং থেকে দুটো ব্যাগ টেনে সরাচ্ছে। আমাকে দেখে স্ট্রেট ফেস করে বলল, 
-'শ্বেতা এসেছে। অনেক মদ খেয়ে আছে। আর কান্নাকাটি করে বিচ্ছিরি অবস্থা। শিবাঙ্গি ছাদে নিয়ে গ্যাছে। ' 
বাইরের ঘরের কোনায় ভিজে সপসপে রেইনকোট, লাগেজ। কিচেনসিঙ্কে এঁটো গ্লাস।  
-'মহিলা বলছে এখানে থাকবে এক মাস, আর কিসব বলল বুঝতে পারছিলাম না। তোর ফোন বন্ধ ক্যান বাঁড়া?'
সেই যেবার উইকেন্ডার থেকে ফিরে রাতে আমাদের বাড়িতে সবাই ঘুমিয়েছিল সেইবার আমার গিটারটা বাজিয়ে অনেক র‍্যান্ডম গান শুনিয়েছিল শ্বেতা। সেলফ ডাউট কাটিয়ে কথাই বলতে পারিনি ভাল করে ওর সাথে তখনও।
'দাল দস খাঁ শেহর লাহোর-এ অন্দর
বাই কিন্নে ব্যূহে তাই কিন্নিয়া ওয়ারিয়ান?' 

ছাদে কাউকে না পেয়ে শিবাঙ্গিদের ঘরে বেল বাজাতে বৈভব দরজা খুলল। 
-'ডুড,ইওর ক্রাশ হ্যাজ পাসড আউট অন আওার ফ্লোর।'
দেখলাম চিত হয়ে মেঝেতে সংজ্ঞাহীন শ্বেতা। হাতে নিভে যাওয়া সিগারেট। তিন মনি পাঠানকোঠিকে বেঁটেখাটো শিবাঙ্গি কাউচ অব্দি তুলতে পারেনি।
তিনজন মিলে টেনে তুললাম, সারা মেঝে জুড়ে খয়েরি বমি করে ভাসাল শ্বেতা। কষ্ট করে হেসে বলল সকাল থেকে খাখরা আর ওল্ড মঙ্ক ছাড়া কিছু খায়েনি। জল খাইয়ে, ঘুম পারিয়ে ফোন অন করে দেখি মহিলা টেক্সট করেছে,
' please let me stay here for a couple of days? i'm extremely broken. fucked up with almost every contact i have in this city. can't stay home. i need you.'
আর,
'btw, i found a whiskey in your wardrobe. if i finish i'll buy you another by the end of the week.
and you gotta WASH your clothes.'

তিনজনে আর খানিকক্ষণ হেজিয়ে, সিগারেট টেনে নিচে যাওয়ার উপক্রম করছি এমন সময় শ্বেতা খাটে উঠে বসে বলল,
-'ক্যা ম্যায় তেরে অ্যাপারট্মেন্ট মে আভি নহা সাকতি হু? নহালুঙ্গি তো ঠিক হো জাউঙ্গি।'
এই বলে সে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মোক্ষম টাস্কি খেল এবং টিভি টেবিল ধরে, হেসে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল। 
আমি বললাম ফ্রিজে চিকেন আছে। চল তোর পেটে খাবার দি কিছু।