ঘড়িঘরের দিক থেকে ভেসে আসা বসন্তের ছোবল মারা হাওয়া বুকের মধ্যে নিকষ কালো গর্ত করে দিয়ে ডাঙ্গার উলটোদিকে পালে ধাক্কা মারতেই তাড়াহুড়ো করে পাল নামানোর তোরজোর শুরু হল।
বসন্তকালের হাওয়ার মধ্যে কিছু একটা কালো ভেল্কি আছে - মন বড়ো হুহু করে ওঠে।
দুরে ঢিপি ঢিপি কালো অন্ধকার মাখা নিস্তব্ব্ধ জঙ্গল, নৌকায় কোনরকম সুর-তালের সঙ্গত ছাড়াই উচ্ছ্বসিত নাচের পদধ্বনি, নিঃশ্বাসের হুশহাশ, আনন্দ-মাখা অর্ধচ্চারিত শব্দ।
রোশন মিঞ্জ-কে এক-পেগ কড়া করে বানানো ওল্ডমঙ্ক হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম 'তোমাদের গ্রামে সব্বাই নাচতে পারে? মানে কোনও নির্দিষ্ট ঘরানার নাচ?'
প্রবল বৃষ্টিতে আমার ঘরের বারান্দায় আটকে পরা জনৈক সুইগি-ডেলিভারিম্যান সপাটে উত্তর দিলো,
'না স্যার, আমাদের কি আর অত লেখাপড়া, মাষ্টারমশাই ওসব আছে? যা মন চায়, তাই নাচি। সাপের লড়া দেখে নাচ পায়, কিম্বা এইরকম বৃষ্টিতে নদীর পাড় ভেঙ্গে পরছে সেই দেখে নাচ পায়। একবার তো পাথরপাড়া ছাড়িয়ে আমার মামার গ্রামে তিনি এলেন...'
'তিনি মানে?'
'বাগ গো স্যার।'
'বাঘ?!'
'হ্যাঁ গো। সেই বাগ দেখে আমার ঠাকুমা এমন নাচলো বাগও পালিয়ে গেলেন। তারপর খুব ঘটা করে পুজো হল।'
প্রবল বৃষ্টিতে দিকনির্ধারণ করা সমুদ্রের দেবতারও অসাধ্য। মেঘ আর তাঁর বৈরিতার জন্যেইতো এত বৃষ্টি। নৌকার ক্যাপ্টেন, ছিটকে আসা কাদা মুছে তিনি বললেন জঙ্গলের বাইরেই তাঁবু লাগাতে। ইলশেগুঁড়িতে আগুন জালানো বড়ো দায়।
দক্ষিণ-পূর্বের হিন্দু-রাজা তাদের তাড়িয়েছে রাজধানী থেকে। সদ্য পবিত্র রাজধানী বানিয়েছেন রাজা জঙ্গল কেটে, বাঘ তাড়িয়ে। তিনি, তাঁর পূর্বপুরুষ দের মতই বিরাট মন্দির নির্মাণে নিয়োজিত হয়েছেন যা পরবর্তীকালে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ফরাসী কোলোনাইজারদের কাছে আঙ্করভাট হয়ে থেকে যাবে। নৌ-সফরকারীদের বাং-মাছের মত শরীর, কালো আবলুশ-কাঠের মত রঙ, অজানা ভাষা আর প্রকৃতির সাথে একাত্য হওয়ার অপার্থিব ক্ষমতা তাঁর সনাতন হিন্দু ধর্মের আচার-অনুচার, শত্রুমিত্রের সংজ্ঞায় আসছিল না। যখন লড়াই হয় আমাদের নজরের বাইরে তখন দেবতারাও বুঝতে পারেন না কোন পক্ষে থাকা উচিত। তাই হয়ত সুন্দরবনের বসতি গড়ার দিনে নৌ-সফরকারীদের দেশ ছেড়ে আসার অসহনীয় দুঃখ এবং রাগ দিয়েও বাঘ-কুমিরের হাত থেকে চিরকালের জন্যে রক্ষা করলেন। বা হয়ত এই মানুষগুলো নিজের সুরক্ষা আর দিনযাপনের জন্যে প্রকৃতির সাথে হাজার হাজার বছর ধরে মানিয়ে নিয়ে, নিজের ওজরমত তাকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারত। কারণ জঙ্গল তো তাঁদের নিজেদের-ই। তারাও জঙ্গলের-ই। কাদাখোঁচা কিম্বা মিষ্টি জলের কুমির আর তাদের কোন তফাত নেই। মেটে ইঁদুর সুনামি, ভূমিকম্পের গন্ধ পায়, তারাও পায়। সভ্যতা শুধু কর্ম-সংস্থান করেনি তাদের মহাজনের খেতে। তারা গন্ধ শুঁকে মিথ্যেবাদীও চিনে নেয় এখন।
পরের কয়েকদিন ধরে ওরা বসতি বানালো সুন্দরবনে। দুর দিয়ে বাদাবনের দিকে মেছোনৌকা যেত, তারা জলের দরে চিংড়ি-কাঁকড়া বেচে আসত। যে চিতি-কাঁকড়ারা গহন বর্ষার দিনে ডিম পারতে আসত বালির খাঁজে তাঁদের কানে কানে ফিসফিস করে দু-কান কথা বলত এরা। জালবন্দী কাঁকড়াগুলি নিস্তব্ধ হয়ে দেখত কোটি কোটি চারা সার বেঁধে কাদার উপর দিয়ে নোনাজলে ভেসে যাচ্ছে নতুন জীবনচক্রের উদ্দেশ্যে। জোছনা কুড়ে খাচ্ছে বালির উপর পদচিহ্ন। পরের বর্ষায় তারা আবার ফিরে আসবে।
আর ছিল গুয়ামৌরী।
তাদের গ্রামে এই গুয়ামৌরী আগে হতোনা। সমদ্রের দেবতা নাকি তাঁর স্ত্রীর শরীরের মেছোগন্ধ সহ্য করতে পারতেন না। তিনি সর্বদাই বিমর্ষ, তাই এই অঞ্চলের উপকূল ঘিরে রইত ঘন মেঘের আড়ালে। প্রতিদিন সূর্য ডোবার আগে অঝরে বৃষ্টি হত।
তখন জঙ্গলের দেবী তাঁকে এই গুয়ামৌরী এনে দেন, তাঁদের প্রাসাদের বেডরুমে ঘিয়ের সাথে জালানোর জন্যে। অন্তর্বাসে রাখার জন্য।
পরে এই গুয়া মৌরীর আশ্চর্য গন্ধের কথা জানাজানি হওয়ায় দেবতার পৃষ্ঠপোষকেরা টা ব্যাবহারের সুযোগ পায়। তখন রাজপ্রাসাদের এক বাবুর্চি খানিকটা গুয়া মৌরী চুরি করে রাখে যাতে পরে স্মাগল করতে পারে। ঘটনাচক্রে একদিন মাতাল অবস্থায় রান্না করতে করতে ভুলবশত খানিকটা গুয়া মৌরী মাংসের সুরুয়ার মধ্যে পড়ে যায়।
অজানা মিষ্টি গন্ধে ছোটবেলার স্মৃতি মনে পরে বাবুর্চির। হঠাৎ শীতের কুয়াশা নেমে আসে, তার মাঝে ভোরের সূর্য ওঠার নরম ওম চারদিকে ছড়িয়ে পরে। সারা রাত ধরে ফসল কাটার ক্লান্তির সাথে গরম গরম খাবার আর বিশ্রামের কথা মনে পরল। ম ম করছে তখন সদ্য কাটা ধান আর মাংসের সুরুয়ার গন্ধ। উঠানের কোনায় গুড় জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। চালের রুটি বানানো হচ্ছে। সদ্য কাটা মাছের টুকরো লাফাচ্ছে কুয়োর ধারে। ভীষণ আরামে ঘুম এসে গ্যাল তার।
গুয়া মৌরী খাবারে দেওয়ার রেওয়াজ তখন থেকেই।
রাজার তদবিরে উত্তর-পূর্বের আগ্নেয়গিরির দিকের জঙ্গলে অভিযান করা হল। প্রাণ গ্যাল কতো লোকের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুঁজে আনা হল গুয়ামৌরীর চারা। প্রচণ্ড গোপনীয়তার সাথে চাষ করা হল সেই চারা। শীতের শুরুতে ফসলের বন্যা হয়ে গেল। সমুদ্রের ওপারের বেদুইনরা বহর নিয়ে এলো, সোনা-মাণিক্য দিয়ে কিনে নিয়ে গেল গুয়ামৌরী।
সেই দেবতাদের দুর্লভ গুয়ামৌরী তারা নৌকা করে এনেছিল তাদের নতুন বাসস্থানে।
নতুন মাটি-জলে গুয়ামৌরীর আচার আচরণ গেল বদলে।
লোকে বলল, গুয়ামৌরী বিষ! এর স্বাদে-গন্ধে মানুষ পাগল হয়ে যায়।
গুয়া মৌরীর প্রভাবে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ল নাচের রোগ।
ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-ঝি দরজা খুলে রাস্তায় নেমে পরল নাচতে নাচতে।
বসন্তের আলোয় হিজাব ছিঁড়ে দলে দলে মেয়েরা নাচতে নাচতে ঢুকে পরল পুকুরপাড়ের মসজিদে।
যাদের মন্দিরে ঢোকা মানা তাদের নাচের চোটে কেঁপে উঠল দালানকোঠা, নাটমন্দির।
জমিদারের কোতোয়ালি জমে উঠল গরীব অপরাধীদের নাচে।
জঙ্গল নেচে উঠল কাঠুরিয়া, মৌলীদের সাথে।
লাটসাহেবের কর্মচারীদের বাংলো ভয়ে কেঁপে উঠল নেটিভের আনহোলি নাচে।
নীল আর পোস্তর খেত নেচে উঠল।
বন্দর নেচে উঠল।
রোদ্দুর নেচে উঠল, রাতের ঝিঁঝিঁর ডাকও নেচে উঠল।
যতক্ষণ ক্লান্তি নেই ততক্ষণ নাচ।
সুইগি-ডেলিভারিম্যানের বক্তব্য অনুযায়ী গুয়ামৌরী থেকে ছড়িয়ে পরা নাচের মহামারীর কারণে সরকারের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের যথেষ্ট অসুবিধা হয়, তাই পুলিস-প্যারামিলিটারি পাঠিয়ে সমস্ত গুয়ামৌরীর ফসল জ্বালিয়ে উজাড় করে দেওয়া হলো। কিন্তু নাচের রোগ এখন কিছু লোকের সারেনি। বরং বংশপরম্পরায় রোগ বয়ে এসেছে তারা।
যখন তখন মাথাচারা দিয়ে ওঠে।